Wellness Care

টাইফয়েড জ্বর কি, কেন হয়, লক্ষণ ও এর প্রতিকার

বাংলাদেশের টাইফয়েড খুবই পরিচিত একটি জ্বর। টাইফয়েড জ্বর কি, কেন হয়, এর লক্ষণ কি, এই জ্বর হলে আপনি কি করবেন এই পোস্টে আলোচনা করা হলো।

টাইফয়েড জ্বর কি

Salmonella Typhi নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে জীবাণু ঘটিত যে রোগটি হয়ে থাকে তাকে টাইফয়েড জ্বর বলে। এটি একটি পানিবাহিত রোগ। 

এটি সংক্রমিত হওয়ার পরে যদি প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা না করা হয় তাহলে এ রোগীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে গুরুতর হতে থাকে এবং এ ব্যাকটেরিয়া শরীরের অন্যান্য অঙ্গ সমূহে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 

সাধারণত আক্রান্তের সপ্তাহখানেক এর মধ্যেই এ রোগের লক্ষণ সমূহ দেখা দেয়। সকল বয়সের মানুষই এ  ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে  শিশুদের জন্য এটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। 

বাংলাদেশে এ রোগের সংক্রমণ অনেক বেশি, তবে অন্যান্য দেশে এ রোগের সংক্রমণ নিয়ে বললেই চলে। টাইফয়েড জ্বর কি তা নিচে পড়লে আরো জানবেন।

টাইফয়েড জ্বর কেন হয়

প্রথমেই  বললাম টাইফয়েড জ্বর কি, এখন জেনে নেই টাইফয়েড জ্বর কেন হয়।

যেহেতু এটি একটি পানি বাহিত রোগ, এ কারণে এটি দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়ে থাকে। ব্যাকটেরিয়া দুইটির নাম হলো: সালমোনেলা টাইফি এবং সালমোনেলা প্যারাটাইফি। 

এ রোগের জন্য প্রধানত দায়ী দূষিত পানি ও খাবার এবং ঘনবসতিপূর্ণ বাসস্থান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবেও মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। 

যদি আক্রান্ত রোগী মল ত্যাগের পর সঠিকভাবে তার হাত পরিষ্কার না করে এবং বিভিন্ন জিনিস স্পর্শ করে তাহলে ওইখান থেকে ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

যে সকল রোগী টাইফয়েড জ্বর হতে আরোগ্য লাভ করেছেন কিন্তু তারা এ ব্যাকটেরিয়া নিজেদের শরীরে বহন করছেন তাদেরকেও এ রোগের সংক্রামক হিসেবে গণনা করা হয়। 

এছাড়া এই জীবানু মানুষের পিত্তথলিতে জমা থাকে। তারা তাদের উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আক্রমণ করে বসে। তবে যে ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তার শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া সহজে আক্রমণ করতে পারে না। 

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ

টাইফয়েড জ্বর কি তা বোঝার জন্য প্রথমে এর লক্ষণ জানা প্রয়জন। টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ সাধারণত ৬ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ধরা দেয়, তবে প্রথম এক সপ্তাহ সাধারণত জ্বর থাকে। জ্বর হঠাৎ অনেক বেড়ে যায় আবার কমে যায়। এ রোগের প্রধান কিছু লক্ষণসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো :

  • প্রচন্ড পরিমানে জ্বর থাকে যা ১০৩° বা এর উপর পর্যন্ত ও হতে পারে, 
  • অতিরিক্ত মাত্রায় মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা, 
  • ডায়রিয়া ও বমি হওয়া,
  • শরীরের তাপমাত্রার সাথে  হৃদস্পন্দন ও কমে যাওয়া,
  • ক্ষুধামন্দ ও কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া,
  • পেটে ব্যথা করা এবং পেটে ও পিঠে গোলাপি রঙের দানা দেখা দেওয়া, 
  • জ্বরের সাথে  প্রচন্ড পরিমানে কাশি হওয়া,
  • এমনকি ওষুধ চলাকালীন অবস্থায়ও জ্বর না কমা,

যদি টাইফয়েড জ্বরের সঠিক চিকিৎসা না করা হয় তবে উপরের  লক্ষণগুলোর আরো ভয়ানক রূপ দেখা দিবে। 

টাইফয়েড জ্বরের প্রতিকার 

টাইফয়েড থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। এছাড়া রোগ শনাক্ত হওয়ার পর সঠিক সময়ের মধ্যে এন্টিবায়োটিক টিকা শুরু করলে এ জ্বর ৫ থেকে ৭ দিন এর  মধ্যেই কমতে শুরু করে। 

সাধারণত এই  অ্যান্টিবায়োটিক গুলো টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া গুলোকে মেরে ফেলে। আমাদের দেশে এই অ্যান্টিবায়োটিক টিকা সচরাচর সব জায়গায় পাওয়া যায়। 

টাইফয়েডের দুই ধরনের টিকা বা ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যায়, যা মুখে বা ইনজেকশনের মাধ্যমে  সেবন করা হয়।

এই এন্টিবায়োটিক টিকা নেয়ার সময় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এই  ভ্যাকসিন ১০০% কাজ নাও করতে পারে তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার পাশাপাশি আরো কিছু প্রতিরোধমূলক কাজ জেনে রাখা ভালো। 

  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা।
  • টয়লেট সবসময় পরিষ্কার রাখা।
  • শাক-সবজি ফলমূল  পরিষ্কার করে পরে খাওয়া।
  • রান্নার আসবাবপত্র পরিষ্কার রাখা।
  • খাবার ভালো মতো সিদ্ধ করে খাওয়া।
  • পানি খাওয়ার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুটিয়ে তারপর পান করা।
  • শিশুকে খাওয়ানোর পূর্বে বা টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করা।
  • বাহিরের অর্থাৎ রাস্তার ধারে যে সকল খাবার বা পানি পাওয়া যায় সেগুলো থেকে বিরত থাকা।

শিশুর টাইফয়েড হলে করণীয়

ছোট বড় সবারই টাইফয়েড জ্বর হতে পারে কিন্তু ছোটদের ক্ষেত্রে এটি অনেক জটিল সমস্যা। শিশুদের বয়স অনুযায়ী এর লক্ষণ বিভিন্ন হতে পারে। যেমন, 

গর্ভাবস্থায় থাকা শিশুর টাইফয়েড: গর্ভাবস্থায় থাকা অবস্থায় মায়ের যদি টাইফয়েড রোগ হয় তাহলে এই রোগে শিশুর হতে পারে। আর যদি শিশুর হয়ে থাকে তবে তিন দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিবে অথবা ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। 

এক বছর বয়সী শিশুর টাইফয়েড: টাইফয়েড যেহেতু পানি বাহিত রোগ তাই এটি যে কারো হতে পারে। আর এ রোগ হলে এর কিছু লক্ষণ শিশুর মধ্যে দেখা দিবে। যেমন বমি, পেট ফাঁপা, পেটে ব্যথা, খাবার রুচি, তীব্র জ্বর, ডায়রিয়া ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখা দিবে। 

শিশুদের এই রোগ দেখা দিলে কোন অবহেলা না করে অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে এর চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ডাক্তার তার সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা দিলে খুব দ্রুত আপনার শিশু সুস্থ হয়ে যাবে।

এই সময় অবশ্যই আপনার শিশুকে প্রচুর পরিমাণে ফুটন্ত পানি খাওয়াতে হবে এবং তরল খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে। শিশুকে অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

টাইফয়েড জ্বর কি ছোঁয়াচে

হ্যাঁ, এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ। এই জ্বর সংক্রমণের বিভিন্ন মাধ্যম গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দূষিত খাবার ও পানি, দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন ও বাহক নিজে। নিচে এই সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

টাইফয়েড ছড়ানোর সবচেয়ে সাধারণ উপক্রম হলো টাইপি ব্যাকটেরিয়া যা দূষিত পানি ধারা সংক্রমিত হয়। একজন বাহক যদি কোন খাবার তৈরি করে তাহলে এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে পারে।  তাই সংক্রমক ব্যক্তিকে এই ধরনের কাজ হতে বিরত থাকতে হবে।

সংক্রমিত ব্যক্তি যদি সঠিক নিয়ম অনুসরণ না করে তাহলেও এ রোগ ছড়াতে পারে। যেমন ব্যক্তি যদি টয়লেট ব্যবহারের পর সঠিকভাবে তার হাত পরিষ্কার না করে। টাইফয়েড জ্বর কি ভাবে ছড়ায় তা আরো জানবো। 

সে যদি একজন  শারীরিকভাবে সুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে এবং তাকে স্পর্শ করে তাহলে তার মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়াটি সুস্থ  মানুষকে আক্রান্ত করতে  পারবে। 

অনেক সময় এমন হয় যে, টাইফয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠেছে কিন্তু তার মধ্যে এই ব্যাকটেরিয়া থেকে যেতে পারে। এই ধরনের ব্যক্তিরা বাহক হিসেবে কাজ করে। বাহক অজান্তে খাদ্য পানি ও অন্যান্য পৃষ্ঠকে দূষিত করতে পারে যার মাধ্যমে এ  রোগ টি বিস্তার লাভ করে। 

টাইফয়েড জ্বর কি ভাবে ছড়ায় তা এতক্ষণে আপনারা বুঝতে পেরেছেন।

টাইফয়েড জ্বর হলে যেসব খাবার হওয়া উচিত

টাইফয়েডে মানুষের শরীর অনেক দুর্বল হয়ে যায়। এই কারণে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও কমে যায়। তাই জ্বরে আক্রান্ত রোগীর কিছু পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন।

টাইফয়েড জ্বর কি ধরনের খাবার, রোগীর খাদ্য তালিকা থাকা দরকার তা হলো:

  • সিদ্ধ ডিম বা ডিম সবজি দিয়ে স্যুপ
  • মুরগির মাংস ও সবজি দিয়ে সুপ। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায় এবং রোগীর জন্য এটি খাওয়াও সহজ।
  • বিভিন্ন ফলের রস যেমন লেবু, মাল্টা, বেদানা, আনারস ইত্যাদি। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে এবং মুখের রুচি বাড়াতে সাহায্য করে। 
  • প্রচুর পরিমাণে ডাবের পানি পান করা। ডাবের পানিতে পটাশিয়াম সহ অন্যান্য মিনারেল আছে যা শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ করবে ।
  • জাউ ভাত খাওয়া।  এ সময় রোগীকে শক্ত খাবার না দেওয়াই ভালো তাই জাউভাত একটি সহজতর খাবার হতে পারে।
  • ডাল, চাল ও অন্যান্য সবজি দিয়ে পাতলা খিচুড়ি ও রান্না করে খাওয়ানো যাবে।
  • মুরগির মাংস ও কবুতরের ঝোল খাওয়া যেতে পারে।
  • মধু দিয়ে তৈরি করে কাস্টার্ড বানিয়ে রোগীকে খাওয়ানো যেতে পারে। 

টাইফয়েডে যেসব খাবার নিষেধ 

টাইফয়েড জ্বর হলে রোগীকে তৈলাক্ত ও মসলা জাতীয় খাবার থেকে বিরত রাখতে হবে। এছাড়া বাহিরের  কোন খাবার  খাওয়া যাবেনা।

মোটা চালের ভাত না খাওয়াই ভালো। অতিরিক্ত চা, কফি থেকে বিরত থাকা কারণ চা, কফি বুকের ধরফরানি বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু কেউ যদি চায় তাহলে মধু দিয়ে লিকার চা তৈরি করে খেতে পারে।

গরুর মাংস, খাসির মাংস না খাওয়া , চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা।  এই সময়ে শাক পাতা খাওয়া যাবে না ।

অর্ধ সিদ্ধ কোন খাবার খাওয়া যাবেনা। 

টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায়
টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায়

টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায়

আমরা অনেকেই মনে করি জ্বর হলে গোসল করা যায় না। এতে জড় আরো বেড়ে যায়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ একটি ভ্রান্ত ধারণা। জ্বর হলে অবশ্যই গোসল করা যাবে।

এমনিতেই গোসল না করলে শরীরের অশান্তি বেড়ে যায়। জ্বর হলে সাধারণত শরীর অনেক ঘামায়, গোসল না করলে জ্বর দিয়ে শরীর আরও খারাপ লাগতে পারে। 

কিন্তু কেউ যদি মনে করে জ্বরের কারণে গোসল করলে তার ঠান্ডা লাগতে পারে বা জ্বর বেড়ে যেতে পারে তাহলে সে গোসল না করলেও চলবে। 

সে চাইলে ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে নিতে পারে অথবা ঘন ঘন জলপট্টি দিতে পারে। এটি আমাদের দেশের একটি চলমান প্রথা। 

প্রশ্ন উত্তর:

টাইফয়েড কি পানিবাহিত রোগ?

উঃ হ্যাঁ, টাইফয়েড একটি পানিবাহিত রোগ। Salmonella Typhi নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এর একটি হয়ে থাকে ।

টাইফয়েড জ্বর কমতে কতদিন লাগে ?

উঃ সাধারণত নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক সেবনের পর ও জ্বর কমতে পাঁচ থেকে ছয় দিনের মত  লেগে যায়। কিন্তু সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে এ জ্বর ভালো হতে সপ্তাহখানেক থেকে মাসব্যাপী ও লাগতে পারে।

টাইফয়েড জ্বর হলে প্রাপ্তবয়স্কদের কোন কোন লক্ষণ দেখা দেয়?

উঃ সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের টাইফয়েড জ্বর হলে দীর্ঘদিন যাবত জ্বর, পেটব্যথা অথবা বুকে পিঠে ছোট ছোট লাল দানাদার গোটা দেখা দেয় ।

টাইফয়েড জ্বর কি মানুষের মাধ্যমে ছড়ায়?

উঃ হ্যাঁ, টাইফয়েড একটি ছোঁয়াচে রোগ। অসুস্থ রোগের স্পর্শে এ রোগ ছড়াতে পারে।

টাইফয়েড জ্বর কি খাবার খাওয়া উচিত?

উঃ টাইফয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বেশি পরিমাণে ডাবের পানি খেতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলের রস খেতে হবে।  ডিম ,সবজি ,মাংস দিয়ে সুপ তৈরি করে খাওয়া যাবে।  এসব খাবার রোগীকে শক্তির  যোগাতে সাহায্য করবে।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা টাইফয়েড জ্বর কি এবং এর সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানতে পারলাম। এই জ্বর হলে আমরা কি কি কাজ থেকে বিরত থাকব এবং এই জ্বর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button